দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব : একটি প্রস্তাব
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব : একটি প্রস্তাব
বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে নীতিগত কোনো মতপার্থক্য জাতির মধ্যে নেই। পার্থক্য যা আছে সেটি হলো তার প্রয়োগ নিয়ে। গণতন্ত্রের সঠিক অনুশীলনের প্রধান বহিঃপ্রকাশ ঘটে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। দেশে বারবার নির্বাচনের নামে প্রহসন হওয়ায় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও সুফল দেশের নাগরিক সমাজ দেখতে পায়নি। ফ্যাসিবাদের পতনের পরে দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। একই সাথে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
রাষ্ট্র মেরামতে নানাবিধ সংস্কার জাতির একটি বড় প্রত্যাশা। তবে সংস্কারের প্রধান ক্ষেত্রটি হচ্ছে সংবিধান সংস্কার। এর মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে বেশ বিতর্ক বা বিভিন্ন ধরনের মতামত রয়েছে। আবার কোনো কোনো দল বলতে চায়, এ সরকারের সংবিধান সংস্কার নিয়ে কাজ করার কোনো এখতিয়ার নেই। সন্দেহ নেই, সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন বা পুনর্লিখন যাই হোক না কেন, তা একটি গণপরিষদ বা জাতীয় সংসদ ব্যতীত অনুমোদন করার আইনগত এখতিয়ার কারো নেই। কিন্তু বর্তমান সরকার যেহেতু জাতির প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এর ফলে বিভিন্ন কমিশন থেকে তারা যে সুপারিশমালা পাবে, সেগুলো পর্যালোচনা করে যা যা তাদের পক্ষে সম্ভব স্বল্পমেয়াদে সেগুলো তারা বাস্তবায়ন করবে এবং যেগুলো পার্লামেন্টের এখতিয়ার সেগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষমাণ থাকবে; বরং বর্তমান সরকার একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচিত সরকারের কাজ এগিয়ে রাখল। এতে বিতর্কের কিছু নেই।
সংবিধান পরিবর্তনের মধ্যে একটি ইস্যু হচ্ছে জাতীয় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা নিয়ে। একটি প্রস্তাব রয়েছে যে সংখ্যাটি ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০-৫০০ করা যেতে পারে। আবার কারো কারো মতে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হলে ভালো হয়। আরেকটি প্রস্তাবনা রয়েছে পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করা। এ দুটো বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে পার্লামেন্টে গঠন প্রসঙ্গে সুবিধা কী কী সেটি দেখা যাক। প্রথমত, এ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে তাদের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। ভোটে কোনো প্রার্থীর ছবি বা নাম থাকে না; শুধু দলের প্রতীক থাকে। ভোটাররা তাদের পছন্দের দলের প্রতীকে ভোট দেয়। নির্বাচনী ফলাফলে যে দল শতকরা যত ভাগ ভোট পায় তার ভিত্তিতে তাদের তালিকা থেকে তত জনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এর সুবিধার দিকগুলো হচ্ছে প্রথমত, বড় দলগুলোর পাশাপাশি ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে কমবেশি আসন পেয়ে যায়। কমপক্ষে যে দল শতকরা ১ ভাগ ভোট পায় সে দলটি অন্তত একটি আসন পাবে। স্বাভাবিকভাবে দলগুলো তাদের মধ্যকার অধিকতর যোগ্য প্রার্থী বা নেতাদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবে বিধায় সংসদে যোগ্যতর সদস্যরা নির্বাচিত হতে পারে। এতে করে পার্লামেন্টের মান বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দ্বিতীয়ত, এতে প্রতিটি ভোটেরই মূল্য পাওয়া যায়। বিজয়ী ও পরাজিত সব দলের প্রতিনিধিই সংসদে স্থান পায় বলে প্রায় সব ভোটেরই একটি মূল্য থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতি ও আদর্শগত পার্থক্য থাকে। পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় ছোট-বড় সব দল পার্লামেন্টে কথা বলার সুযোগ পায় এবং এতে নাগরিকরা তাদের মূল্যায়ন করতে পারে। এ পদ্ধতিতে কোনো দলের পক্ষে একক বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কোয়ালিশন সরকারের বড় অসুবিধা হলো স্থিতিশীলতার সঙ্কট। শরিক দলগুলো সমর্থন প্রত্যাহার করলে যেকোনো সময় সরকারের পতন ঘটে। সাম্প্রতিককালে নেপালে এরূপ সঙ্কটের অভিজ্ঞতা দেখা গেছে। সুতরাং এ ধরনের সরকারের সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই রয়েছে।
অপরদিকে, পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বড় ভয় হচ্ছে, এতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুবিধা নিয়ে কোনো একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বা উগ্র দল পার্লামেন্ট উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক আসন পেয়ে যেতে পারে যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে এবং গণতন্ত্রকেই হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। যেমন সকল স্বৈরাচারের পক্ষে ১০ বা ২০ শতাংশ ভোট থাকতেই পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী দল হওয়া সত্ত্বেও তার একটি বড় সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। এ জন্যই রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ঘোর বিরোধিতা করছেন। সন্দেহ নেই, তার বক্তব্যের সারবত্তা রয়েছে যা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আরেকটি দিক পর্যালোচনা করা যেতে পারে, সেটি সংরক্ষিত মহিলা আসন। তাদের আসনসংখ্যা বেড়ে এখন ৫০টি। এতে মহিলারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত না হয়ে পার্লামেন্ট যে দল যত ভাগ আসন পায় সে দল তত ভাগ মহিলা আসনের হিস্যা পায়। এটিও এক ধরনের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। এটি যদি দলের আসনের অনুপাতে না হয়ে প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার আনুপাতিক হার হতো তাহলে সেটি বেশি ন্যায্য হতো। যেমন ধরি, কোনো দল ভোট পেল মোট ভোটের ৫ শতাংশ কিন্তু আসন পেল না একটিও। তারা ৫ শতাংশ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও পার্লামেন্টে কোনো আসনই পেল না; মহিলা আসনও নয়। কিন্তু মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে মহিলা আসন দেয়া হলে ওই দলটি একটি হলেও আসন পেতে পারে।
এবারে আলোচনা করা যাক দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে। এতে বড় সুবিধা হলো আইনসভায় একটি ভারসাম্য বজায় থাকে। এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট যদি একটি দলের একক বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তখন তারা একরোখা আচরণ করতে পারে। জনগণের স্বার্থবিরোধী আইন বা সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্ট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে জনস্বার্থবিরোধী বহু পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল। আবার ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়া এসব করেছিল। যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকত তাহলে উচ্চকক্ষ হয়তো জনস্বার্থবিরোধী বিল পাস করতে দিত না। বাংলাদেশে যেহেতু কয়েকটি তিক্ত ঘটনা রয়েছে, সেহেতু এখানে ভারসাম্য বিধানের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। আবার এর বিপক্ষেও যুক্তি রয়েছে। যেমন এতে প্রায় একই ধরনের কাজে আইন প্রণয়নে অহেতুক সময়ক্ষেপণ হবে এবং দুই কক্ষ কোনো আইনের বিষয় দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দুই কক্ষের সংরক্ষণ ও পরিচালনায় প্রচুর ব্যয় বেড়ে যাবে। যাই হোক, সব ব্যবস্থাতেই কিছু সুবিধা কিছু অসুবিধা থাকে; নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি উন্নত হলে সমস্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। ব্রিটেনে তো শত শত বছর ধরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চলে আসছে।
উচ্চকক্ষ হবে ৬০ আসনবিশিষ্ট; এর মধ্যে ৫০ জন সাধারণ আসন ও ১০টি মহিলা আসন। বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতিক হারে তাদের প্রার্থীরা সদস্য নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। দলগুলো নির্বাচনের আগেই তাদের ৬০ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। আশা করা যায়, সব দলই তাদের নেতা ও অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবে। ফলে উচ্চকক্ষ হবে সব দলের প্রতিনিধিত্বশীল ও উচ্চ মানসম্পন্ন।
এই প্রস্তাব অনুযায়ী সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে বলে আশা করা যায়। কারণ সব প্রধান দলই পার্লামেন্টে কথা বলার সুযোগ পাবে। বর্তমান সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটি এবং রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব ও গবেষক
Post a Comment