নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কে এখনো ধরা পড়ে ৫০ বছরের পুরোনো মহাকাশযানের সংকেত

নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কে এখনো ধরা পড়ে ৫০ বছরের পুরোনো মহাকাশযানের সংকেত



১৯৭৭ সালের কথা। তখন পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল দুইটি মহাকাশযান — Voyager 1Voyager 2। এই মহাকাশযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর তথ্য সংগ্রহ এবং মানব সভ্যতার একটি ক্ষুদ্র বার্তা বহন করে মহাবিশ্বে প্রেরণ। তখন হয়তো কল্পনাও করা যায়নি যে এই মহাকাশযানগুলো ৫০ বছর পরেও পৃথিবীতে সংকেত পাঠাবে — এবং সেই সংকেতগুলো এখনো ধরা পড়ে নাসার এক বিশেষ নেটওয়ার্কে, যার নাম Deep Space Network (DSN)


নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক কী?

NASA Deep Space Network (DSN) হলো এক বিশাল বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত রয়েছে — মূলত ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র), মাদ্রিদ (স্পেন) এবং ক্যানবেরা (অস্ট্রেলিয়া) — এই তিনটি জায়গায়।
এগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে পৃথিবী যেকোনো সময় ঘুরলেও, মহাকাশে অবস্থানরত মহাকাশযানের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ বজায় রাখা সম্ভব হয়।

DSN-এর কাজ হচ্ছে:

  • দূরবর্তী মহাকাশযান থেকে সংকেত গ্রহণ করা

  • পৃথিবী থেকে কমান্ড পাঠানো

  • ছবি ও ডেটা ডাউনলোড করা

এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আন্তর্মহাকাশ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত।


ভয়েজার: মহাকাশে মানব সভ্যতার দূত

Voyager 1 ও 2 ছিল মানবজাতির প্রথম কিছু মিশনের অংশ, যারা বৃহস্পতির চাঁদ, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের কাছে গিয়ে সরাসরি ছবি ও ডেটা পাঠিয়েছিল। এই মিশনগুলো এতটাই সফল হয়েছিল যে, মূল মিশন শেষ হওয়ার পরেও তাদের যাত্রা বন্ধ হয়নি।

বর্তমানে, Voyager 1 মানব ইতিহাসে সবচেয়ে দূরবর্তী মহাকাশযান, যেটি এখন ২১ বিলিয়ন কিলোমিটার (১৩ বিলিয়নের বেশি মাইল) দূরে অবস্থান করছে। Voyager 2-ও এর থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই।

এই বিশাল দূরত্ব থেকেও এরা এখনো পৃথিবীতে সংকেত পাঠাতে সক্ষম — এবং সেই সংকেত ধরেই কাজ করছে ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক


কীভাবে এই সংকেত কাজ করে?

Voyager মহাকাশযানগুলোতে রয়েছে 70s-এর দশকের প্রযুক্তি, যেখানে কম্পিউটার মেমোরি মাত্র ৬৪ কিলোবাইট এবং সংকেত পাঠানো হয় ২৩ ওয়াটের রেডিও ট্রান্সমিটারে — যা একটি স্ট্যান্ডার্ড বাল্বের শক্তির চেয়েও কম।

এত দুর্বল সংকেত, এত বিপুল দূরত্ব পেরিয়ে যখন পৃথিবীতে আসে, তা এতটাই ক্ষীণ হয় যে তা ধরা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু DSN-এ থাকা বিশাল অ্যান্টেনাগুলো (যেগুলোর ব্যাস ৭০ মিটার পর্যন্ত) সেই সংকেত ধরে, প্রসেস করে, এবং তা বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় — Voyager 1 থেকে যে সংকেত আসে তা ২০ ঘণ্টা সময় নেয় পৃথিবীতে পৌঁছাতে। আর সেই সংকেত এতটাই দুর্বল যে তা একটি ঘড়ির টিকটিকির চেয়েও কম শক্তির।


কেন এখনো চলছে এই যোগাযোগ?

নাসা Voyager মিশনকে এখন "Interstellar Mission" হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এখন এদের প্রধান কাজ হলো:

  • সৌরজগতের সীমানার বাইরের পারিপার্শ্বিকতা বোঝা

  • আন্তঃনাক্ষত্রিক কণাগুলোর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা

  • মহাজাগতিক বিকিরণ ও প্লাজমা পর্যবেক্ষণ করা

এইসব তথ্য মানবজাতিকে ভবিষ্যতের আন্তরীক্ষ অভিযান পরিচালনায় সাহায্য করবে।


চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

যেহেতু Voyager মহাকাশযানগুলো পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি, তাই বর্তমানে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
নাসার অনেক প্রকৌশলী যারা শুরুতে এই প্রকল্পে কাজ করতেন, তারা ইতোমধ্যেই অবসর নিয়েছেন।
তাছাড়া, প্রতি বছর Voyager-এর পাওয়ার সাপ্লাই কমে যাচ্ছে, যার ফলে ২০২৫ সালের পর তাদের সংযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।


শেষ কথা

৫০ বছর আগে তৈরি করা একটি যন্ত্র আজও মহাকাশে সক্রিয় আছে — এটি শুধু প্রযুক্তির কীর্তি নয়, এটি মানবজাতির অদম্য কল্পনা ও অনুসন্ধিৎসার প্রতীক।
Voyager আমাদের শিখিয়েছে যে মহাবিশ্বে আমরা কতটা ক্ষুদ্র, আবার কতটা সাহসীও।
আর এই অভিযানের পেছনে নিরবভাবে কাজ করে চলেছে NASA’র Deep Space Network — বিশ্বের সবচেয়ে অনুগত শ্রোতা, যারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে বহুদূর থেকে আসা একটুকরো সংকেতের।